আব্দুর রাজ্জাক বিশেষ প্রতিনিধি:
নীলফামারীতে আলু চাষ করে অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও ভালো বীজের অভাবে অধিকাংশ কৃষকই ফলনে মার খাচ্ছেন। কেননা, ভাইরাসমুক্ত টিস্যুকালচার বীজের অভাবে আলুচাষিরা হিমাগার বা ঘরে রাখা বীজ রোপণ করে আশানুরূপ ফলন পাচ্ছেন না। কৃষকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে শুধু ভালো বীজের কারণে প্রতিবছর ফলনে মার খাচ্ছেন।
এই অঞ্চলের আলু গাছের নীরব ঘাতক ভাইরাস। ক্ষেতে ভাইরাসের আক্রমণ বেড়ে গেলে ফলন অর্ধেকে নেমে আসে। এতে কৃষকের আর্থিক বিপর্যয় ঘটে। সেটি বিবেচনা করে গুণগত আলুবীজের চাহিদা ও কৃষকদের হয়রানি বন্ধে গত দুই বছর ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘মানসম্পন্ন বীজআলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং কৃষকপর্যায়ে বিতরণ জোরদারকরণ প্রকল্প’।
এর আওতায় নীলফামারী জেলা শহরের গাছবাড়ী সংলগ্ন নীলফামারী বীজবর্ধন খামারের অভ্যন্তরে ২ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার একটি বীজআলু হিমাগারের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। এ অঞ্চলে বীজআলু উৎপাদনের দায়িত্বে রয়েছেন ডোমার ভিত্তি বীজআলু উৎপাদন খামার।
এ খামারের আওতায় ২০২৩-২৪ উৎপাদন মৌসুমে ৩১ জন চুক্তিবদ্ধ চাষির মাধ্যমে ১৯টি ব্লকে ৮ জাতের (সানসাইন, প্রাডা, সানতানা, কুম্বিকা, এস্টারিক্স, মিউজিকা, কারেজ, ক্যারোলাস) ১২৬.৮৫ একর ভিত্তি এবং ৬টি জাতের (সানসাইন, সানতানা, লেবেলা, এস্টারিক্স, কারেজ, এলোয়েট) ১৫৩.৪৮ একর প্রত্যায়িত এবং সানসাইন জাতের ১৫ একর মানঘোষিতসহ সর্বমোট ২৯৫.৪০ একর জমিতে বীজআলু উৎপাদন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়।
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক হতে শষ্যবন্ধকী ঋণের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ চাষিদের বীজ, সার, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক সরবরাহ করা হয়। খামারে কর্মরত কৃষিবিদরা সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে প্রতিদিন সংশ্লিষ্ট জোনের প্রতিটি ব্লকের সমস্যা চিহ্নতকরণ পরামর্শ প্রদান ও উৎপাদন কার্যক্রম তদারকি করে থাকেন। ২০২৩-২৪ উৎপাদন মৌসুমে ২৯৫.৪০ একর জমিতে উৎপাদিত বীজআলুর পরিমাণ ছিল ১৫২২.৮৫০ মে. টন। ২৯৫.৪০ একর বীজআলু উৎপাদনের জন্য রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক হতে ২ কোটি ১২ লাখ, ৩৪ হাজার ২৪১ টাকা শষ্যবন্ধকী ঋণ পরিশোধ করা হয়। ৩১ জন চুক্তিবদ্ধ চাষিকে ৫ কোটি, ৪৩ লাখ, ৩০ হাজার ৮৫০ টাকা প্রদান করা হয়। চাষিদের বীজআলু উৎপাদন খরচ ও বিভিন্ন আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে একরপ্রতি ১ লাখ ১২ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। ২০২৪-২৫ উৎপাদন মৌসুমে ৩০টি ব্লকে ৭৬ জন চুক্তিবদ্ধ চাষির মাধ্যমে ১২ জাতের (এস্টারিক্স, মিউজিকা, গ্রানোলা, কুইন অ্যানি, কারেজ, কুম্বিকা, এলোয়েট, ৭ ফোর ৭, সানতানা, কার্ডিনাল, ডায়মন্ট, বারিআলু ৬২) ৪১৮ একর ভিত্তি এবং ১১ জাতের (মিউজিকা, সানতানা, কারেজ, এস্টারিক্স, গ্রানোলা, কুম্বিকা, সানসাইন, বারিআলু ৭২, ভ্যালেন্সিয়া, ডায়মন্ট, কার্ডিনাল) ৩৩৫ একর প্রত্যায়িতসহ সর্বমোট ৭৫৩ একর জমিতে বীজআলু উৎপাদন কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এবারেও খামারে কর্মরত কৃষিবিদরা প্রতিটি ব্লকের উৎপাদন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও পরামর্শ প্রদান করে আসছেন। ২০২৪-২৫ উৎপাদন মৌসুমে ৭৫৩ একর বীজআলু উৎপাদনের জন্য রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক হতে ৫ কোটি, ৭৫ লাখ ২০ হাজার ৪২০ টাকা শষ্যবন্ধকী ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ৭৫৩ একর জমিতে ৪৫০০ মে. টন বীজআলু উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট চাষি হতে উৎপাদিত বীজআলুর আর্থিক মূল্য প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এতে তাদের প্রায় ৮ কোটি টাকা মুনাফা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পরবর্তী বছর উৎপাদিত বীজের প্রায় ১৫ গুণ ফসল উৎপাদন হবে বলে আশা করছে কৃষিবিদরা।
নীলফামারী বীজআলু উৎপাদন জোন ভৌগোলিকভাবে এমন একটি এলাকায় অবস্থিত যেখানে বীজআলু উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া বিদ্যমান রয়েছে। ভবিষ্যতে নীলফামারী বীজআলু উৎপাদন জোন এরই মধ্যে বাংলাদেশের মধ্যে একটি সম্ভাবনাময় জোন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এ কর্মসূচির আওতায় এই এলাকায় শিক্ষিত বেকার যুবকদের বীজআলু উৎপাদনে নিয়োজিত করা হয়েছে। এতে করে এ এলাকার মানুষের মধ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কারণে এলাকার বেকার শিক্ষিত যুবকেরা উদ্যোগী হয়ে বীজআলু উৎপাদন করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
এ ব্যাপারে ডোমার ভিত্তি বীজআলু উৎপাদন খামারের উপপরিচালক কৃষিবিদ আবু তালেব জানান, নীলফামারী অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া আলু আবাদের জন্য উপযোগী। বর্তমানে দণ্ডায়মান ফসলের সার্বিক অবস্থা খুবই ভালো পর্যায়ে রয়েছে, যা হতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গুণগত মানসম্পন্ন বীজআলু উৎপাদন করা সম্ভব হবে। উৎপাদিত বীজআলু দেশের চাষিদের আলু উৎপাদনে বীজআলু সরবরাহের ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিএডিসি কর্তৃপক্ষ সরকার নির্ধারিত মূল্যে এ গ্রেড (২৫-৪০ মিমি) এবং বি গ্রেড (৪১-৫৫ মিমি) সাইজের বীজআলু সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করবে যা পরবর্তী সময়ে মৌসুমে বীজ ডিলারের মাধ্যমে সাধারণ আলুচাষিদের কাছে ন্যায্যমূল্যে বীজআলু সরবরাহ করা হবে।